
রাত ১২টা।
জ্বলন্ত সিগারেট হাতে একা একা রাস্তায় হাটছে রুদ্র।মনে মনে ভাবছে,কি জবাব দেবে সে নিলাকে?
আজও রুদ্র ভুলে গেছে নিলার সাথে দেখা করার কথা।
সম্পর্কের শুরু থেকে ওরা কখনো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত একসাথে না থেকে পারেনি।অনেকটা নিয়মের মতই হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু প্রথম দিকে এরকম ছিল না।সম্পর্ক শুরুর পর থেকে সপ্তাহের শেষ দিনটাতে যেন ওদের দেখা করতেই হবে।হয়তো এটাও ভালবাসার কোন অংশ ছিল।অথবা তখন ওরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছিল তাই হয়তো পেরেছে।
এখন জীবনটা অনেক পালটে গেছে।নিলা-রুদ্র দুজনই চাকরী করছে।দু’জনই ব্যস্ত থাকে সপ্তাহ জুড়ে।তবুও সপ্তাহের শেষ দিনটায় ওরা চেস্টা করতো দেখা করবার।কিন্তু এই কয়েকমাস রুদ্রর ব্যস্ততা তার ভালবাসা থেকে কেন যেন দূরে সরিয়ে নিতে চাইছে।ব্যস্ততার কারনে শুধু বৃহস্পতিবার কেন, সপ্তাহের কোন দিনই সময় পায়না রুদ্র।অনেক বোঝাতে চেস্টা করেছে রুদ্র ওকে।নিলা বরাবর বুঝতে পারে সম্মতি দিলেও নিজের অন্তরালে কেন যেন ওর কান্না শুনতে পায়।কোন এক মনীষি বলেছিলেন, “ভালবাসা মানে শূন্যতা।শূন্য থেকেই এর শুরু আর শূন্যতেই পূর্নতা”।তবে কি এই সেই পূর্নতা যা শুন্যতার ডাক দিচ্ছে রুদ্রকে।
হঠাত ফোনের শব্দে মনের সকল অবচেতনা থেকে নিজেকে বাস্তবে আবিস্কার করলো।হাতে নিতেই দেখলো নিলার ফোন।কিন্তু সবুজ সংকেতের ওই হ্যা সুচক বোতামে চাপ দেবার সাহস ও পাচ্ছে না।কি বলবে ও নিলাকে?তবুও মনের একটা জোর এখনো অবশিষ্ট,আর তা হলো রুদ্র নিলাকে ভালবাসে।
“হ্যালো”-কিছুটা আস্তেই বললো রুদ্র।
“বাড়ি ফিরেছো?”-স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলো নিলা।
কিছুট ইতস্তত ভাবে রুদ্র উত্তর দিলো “না,আসলে...এইতো যাচ্ছিলাম আর কি”
“তারাতারি যাও।রাস্তায় একা একা হাটতে নেই এত রাতে” নিলার কন্ঠ পুরো স্বাভাবিক।
কথাটা শেষ করেই নিলা ফোন কেটে দিলো।
রুদ্র নিলার এই ব্যবহারের সাথে আগে থেকেই পরিচিত।কারন গত কয়েকমাস ধরে প্রতি বৃহস্পতিবার নিলার সাথে দেখা না হলে সে একা একা রাস্তায় হাটতে হাটতেই বাড়ি ফেরে।নিলাও এটা জানে।
রাত ১টা।
এখনও ও রাস্তায় হাটছে।
পকেট থেকে আরও একটা সিগারেট বের করলো।কিন্তু সিগারেট ধরাবার জন্য লাইটার নেই।আশে পাশে কোন দোকানো নেই এতরাতে।মনে মনে নিজেকেই গালি দিতে শুরু করলো রুদ্র।
হঠাত পেছন থেকে একজন বলে উঠলো “লাইটার লাগবে?”
রুদ্র পেছন ঘুরতেই আবিস্কার করলো মাঝবয়সী একটি লোক ওর পেছনে দাড়িয়ে।মুখভর্তি দাড়ি,মাথা ভর্তি চুল।গোফও আছে।পড়নে অফ-হোয়াইট রঙের একটা ময়লা পাঞ্জাবী আর জিন্স।
“লাইটার লাগবে?” রুদ্রকে কিছু না বলতে দেখে আবারও জিজ্ঞাসা করলো।
“হ্যা লাগবে” রুদ্র এবার মুখ খুললো।
লোকটা তার লাইটারটা রুদ্রকে দিলেন,রুদ্র সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা ফেরত দিয়ে বললো “ধন্যবাদ”
কথাটা বলেই রুদ্র হাটতে শুরু করলো।আসলে লোকটা যেই হোক না কেন রুদ্র লোকটার সাথে কথা বাড়াতে চায় না।
“তারা হুড়োয় নাকি বেশ?” পেছন থেকে লোকটা বলতে শুরু করলো
রুদ্র কথা না বাড়িয়ে সামনে হাটছে।কিন্তু আশ্চর্য,লোকটাও ওর পেছনে পেছনে আসছে।রুদ্র তার হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো।কিন্তু লাভ হচ্ছে না,ও যত দ্রুত হাটছে,লোকটাও ততই দ্রুত হাটছে।
প্রায় পনেরো মিনিট হাটার পর রুদ্র ভাবতে থাকে এভাবে তার পক্ষে হাটা সম্ভব নয়।কিন্তু আশে পাশে কোন ট্যাক্সি বা গাড়িও নেই এতরাতে।সে এবার ভাবে,তার আজকের দিনতাই খারাপ।এ নিশ্চই ছিনতাইকারী।সামনে আরও কেউ অপেক্ষা করছে হয়তো।তাই ও ঝামেলায় না গিয়ে দাড়িয়ে পেছনে ঘুড়েই লোকটাকে বলতে শুরু করলো-
“দেখুন,আমার সাথে আপনার নেয়ার কিছুই নেই।মানিব্যাগে ১০০০ টাকা আছে আর মোবাইল।আপনি এগুলো নিয়ে যান।শুধু সিমকার্ডটা দিয়ে যান।তবুও আমি কোন ভেজাল চাইছি না!”
লোকটা হঠাত এ কথা শুনে অনেকতা চিতকার করেই হাসতে শুরু করলো রাস্তায়।এতটা জোড়ে হাসছে যেন লোকটার হাসির প্রতিদ্ধনি রুদ্রর কানে তীরের মত লাগছে।
“আমাকে কি আপনি ছিনতাইকারী ভেবেছেন?” কথাটা বলেই লোকটা আবার হাসতে লাগলো।
রুদ্র পুরো অবাক।কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
“কি চান আপনি?”-কিছুটা রেগেই বলে উঠলো রুদ্র।
লোকটা এবার হাসি থামিয়ে বলতে শুরু করলো-“ কিছু না।আপনার সাথে গল্প করতে চাই”
রুদ্র অবাক “মানে কি?”
“খুব সোজা।আপনিও একাকিত্ত্বে ভুগছেন,আর আমিও।তাহলে কেন নয়?” লোকটা স্বাভাবিক।
“কিন্তু আপনাকে কে বললো যে আমি একাকিত্ত্বে ভুগছি?” রুদ্র প্রশ্ন করলো।
“মশাই,বড্ড বেশি সন্দেহ আপনার মনে।আপনিই বলুন রাত এখন প্রায় দু’টোর কাছাকাছি।এতরাতে এত ভালো পোশাকের যদি কোন ব্যক্তি হাটতে হাটতে হঠাত কোন চিন্তায় হারিয়ে যায়,আর রাস্তার মাঝ পথে দাঁড়িয়ে পরে তাহলে কি ভাববো?”
“মানে?” আবারো প্রশ্ন রুদ্রর।
“ওহহ....,আপনি অনেক মানে মানে করেন মশাই।যা হোক,ছেকা খেয়েছেন নাকি অন্য কোন মামলা?” লোকটা এবার রুদ্রকে প্রশ্ন করে।
“দেখুন,আমি জানি না আপনি কে।প্লিজ আপনি আমাকে যেতে দিন।আমি অনেক খুশি হবো” একটু রেগেই কথাটা বলে আবারো হাটতে শুরু করলো রুদ্র।
পেছন থেকে লোকটা তখন বলতে শুরু করলো-
“প্রত্যক ভালোবাসার মধ্যবিন্দু আছে।আর সে মধ্যবিন্দু যদি অতিক্রম করতে পারো তবেই তুমি ওকে পাবে।তা না হলে সব কিছুই শুন্যতে গিয়ে নামে”
কথাটা শুনেই রুদ্র দাঁড়িয়ে পড়লো।পেছনে ঘুড়ে তাকাতেই অবাক করা জিনিস,লোকটা নেই!
রুদ্র এবার ভয় পাচ্ছে।দ্রুত পায়ে হাটতে শুরু করলো।দ্রুত...অনেক দ্রুত হাটছে রুদ্র।
রাত ২টা বেজে ৩০ মিনিট।
রুদ্র হেটেই চলেছে।চারদিকে অন্ধকার লাগছে।রাস্তার লাইটগুলোরও মনে হয় ইলেক্ট্রিসিট নেই।একটা গাড়িও নেই রাস্তায়।আশ্চর্য লাগছে রুদ্রের কাছে।প্রায় দুই ঘন্টা হলো সে অফিস থেকে বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে।যেখানে হেটে পৌছতে আধ ঘন্টার উপর লাগে না সেখানে তার প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যাচ্ছে আজ।সে নিজেও বুঝতে পারছে না তার কি হয়েছে।আশে পাশের সব কিছুই পরিচিত।অপরিচিত কোন রাস্তায় সে নেই।তারপরও এতক্ষন লাগছে তার পৌছতে।ওইদিকে সেই লোকটার হটাত গায়েব হওয়া।কোথা থেকে আসলে আর কোথায় গেলো কে জানে।কিন্তু লোকটায় কথাগুলো বেশ অদ্ভুত।মনে হয় যেন কিছু একটা আছে।
“কি!!! আমাকেই ভাবছিলেন তো?” হঠাত রুদ্রর সামনে সেই লোকটা হাজির।
লোকটাকে দেখে রুদ্র পুরো ভয়ে চুপসে গিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়লো। “আপনি!!! আপনি আবার!!!”
“আরে মশাই,আমি ভুত না।এই নিন,আমার হাত ছুয়ে দেখুন,নিন নিন...ধরুন,উঠে দাড়ান।” লোকটা তার হাত রুদ্রর দিকে এগিয়ে দেয়।রুদ্র লোকটার হাত ধরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়।অনেক খস খসে হাতটা।অনেকটা দিনমজুরদের হাতের মত।
“চলুন! আগাই...” লোকটা বলে হাটতে শুরু করলো।
অনেকটা নিরবতা নিয়েই দুজন হাটছে।লোকটা সামনে আর রুদ্র তার একটু পেছনে।রুদ্রর ভয় এখনও কাটছে না।ও লোকটার চরিত্র নিয়ে এখনও সন্দিহান।
প্রায় ৩০ মিনিট হাটার পর লোকটা বলতে শুরু করলো-
“আমাদের সমস্যা কি জানেন? আমরা যখন কাউকে ভালবাসি তখন তাকে ঠিক যেই সময়টাতে ভালবাসি সেই সময়টাতেই সারাজীবন দেখতে চাই।কিন্তু আমরা মানতে পারি না যে সময় পালটে যায়।আমরা ভালোবাসতে থাকি,কিন্তু সম্পর্কের যে ফাটল ক্রমাগত সৃস্টি হচ্ছে তা ঠিক করতে চাই না।” কথাটা বলতে বলতে লোকটা পকেট থেকে সিগারেট বের করলো।সিগারেট ধরিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো-
“ভালোবাসা কোন দায়িত্ববোধ না,এটা অনুভূতি।ভালবাসা স্পর্শে,ভালোবাসা আলিংগনে।ভালোবাসা কোন এসি রুমের ডেস্কে বসে টাকা উপার্জন করে ভোগ করা নয়।যাকে ভালোবাসো তাকে সময় দাও।তা না হলে জ়ীবন থেকে সময় হারিয়ে যাবে।আর সময় হারিয়ে গেলে জীবন...” লোকটির মুখে মলিন হাসি।
“আপনি এগুলো আমাকে কেন বলছেন?” রুদ্রর প্রশ্ন।
“সময় হারিয়ে যাচ্ছে....”লোকটার উত্তর।
“কে আপনি?” রুদ্রর সন্দিহান জিজ্ঞাসা।
হঠাত চারদিক থেকে একটা প্রচন্ড বাতাস আসতে লাগলো,রাস্তার ধুলো উড়েতে থাকায় রুদ্রর চোখে লাগতে লাগলো।রুদ্র চোখ বন্ধ করে ফেললো।
চোখ খুলতেই দেখলো লোকটা নেই।
ডান দিকে তাকাতেই দেখলো রুদ্র ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে।
সকাল ৬টা
ঘড়ির এলার্ম বাজতে শুরু করেছে।
বিঝানা থেকে উঠে এলার্ম বন্ধ করে সোজা বাথরুমে চলে গেল রুদ্র।মুখে পানি দিতেই ওর রাতের কথা মনে পরে যায়।কথাগুলো কেন যেন ওর কানে বার বার বাজতে লাগলো,কে যেন ওকে বলছে “সময় হারিয়ে যাচ্ছে....”
বাথরুম থেকে বের হয়ে পোশাক বের করছে রুদ্র।অফিসে যেতেই হবে।শুক্রবারও অফিস কামাই নেই রুদ্রর।
পোশাক পড়ে আয়নায় দাড়ায়ি নিজের দিকে তাকাতেই আবারো কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল ওর।কিন্তু কি লাভ? আজ তো দেখা করা সম্ভব নয়।তাছাড়া অফিসেও যেতে হবে।তাই নাস্তা করে বাসা থেকে বের হয়ে যায় রুদ্র।
শুক্রবারেও রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম,দোকান গুলোও খোলা।অবাক হয় রুদ্র,ছুটির দিনেও কি সবাই ওর মত চাকরী করে নাকি তাই ভেবে।
অফিসে পৌছে ডেস্কে বসতেই দেখলো পিয়ন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে ভুলে গেছে।তাই নিজেই উল্টিয়ে দিল।
ক্ষানিক্ষন কাজ করার পর নিলার ফোন,
“তুমি কি আজ আসবে?”নিলার প্রশ্ন।
“আজ?” রুদ্র বুঝতে পারছে না নিলা আজ দেখা করতে চাইছে কেন।
“অনেক দিন হয়ে গেছে তুমি দেখা করো নি।আজও কি করবে না?”নিলার কন্ঠে করুন আকুতি।
“আমি অফিসে,যদি সম্ভব হয় তবে আসবো” রুদ্রর উত্তর।
“আজ শেষ বার সন্ধ্যায় আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।যদি তুমি না আসো তবে কোন দিন নয়।”অভিমান সুরে কথাটা বলে ফোন রেখে দেয় নিলা।
ফোনের লাইন কেটে হাতে নিতেই স্ক্রীনের তারিখের দিকে রুদ্র লক্ষ্য করলো আজ ৬ই অক্টোবর বৃহস্পতিবার।আজ নিলার জন্মদিন।রুদ্রর রাতের কথা মনে পরে যায়।আজ যদি বৃহস্পতিবার হয় তাহলে গতকালের ঘটনাগুলো কি ছিল?রুদ্রর মনে অনেক প্রশ্ন।তবুও রুদ্র নিলাকে ফিরে পেতে চায়।আর এটাই এখন মূল।
আফিস শেষ হবার আগেই বসকে অনেক বুঝিয়ে আজ ছুটি নিয়েছে রুদ্র।টি.এস.সি যেতেই নিলার হাসিমুখ রুদ্রর জীবনটাকে যেন নতুন করে আশার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।সদ্য ভালোবাসার এক স্বাদ পাচ্ছে রুদ্র।
রুদ্র জানেনা কে সেই ব্যক্তি অথাবা সেই রাত্রি কি সত্যি না শুধুই স্বপ্ন ছিল।সে শুধু জানে শুন্যতা মুছে মধ্যবিন্দু ছাড়িয়ে সে ফিরে পেয়েছে তার ভালোবাসা।